বাংলা বা স্থানিয় নামঃ পান। পান আমাদের নিকট অতি পরিচিত। আবহমান কাল হতে পানের ব্যবহার চলে আসছে। সামাজিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে পানের সমাদর সবার আগে। পান নিয়ে অনেক প্রবাদ বাক্য আছে। যেমনঃ‘‘পানে আছে অনেক গুণ, যদি না খাও সঙ্গে চুন।’’ ‘‘ভালোবাসার এমনি গুণ, পানের সাথে যেমনি চুন।বেশি হলে পোরে গাল, কম হলে লাগে ঝাল’’,‘‘পান থেকে চুন খসলেই বিপদ’’,‘‘ছাগলের মুখে পড়লো পান, পান বলে মোর গেল জান’’।আজও গ্রাম বাংলার বিয়ের প্রাথমিক সেতুবন্ধন সৃষ্টি হয় ‘‘পান-ফুল’’ দিয়ে। সুতরাং পান-সুপারির কদর অতিতে ছিল, বর্তমানেও আছে,ভবিষ্যতেও থাকবে। 

ইউনানী নামঃ তাম্বুল

আয়ুর্বেদিক নামঃ নাগবল্লী,তাম্বুলী

ইংরেজী নামঃ Betel leaf

বৈজ্ঞানিক নামঃPiper betle Linn.

পরিবারঃ Piperaceae

পরিচিতঃ লতানো গাছ, ডাটা শক্ত,পাতা ডিম্বাকৃত।সাধারণতঃ ৩-৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়,অগ্রভাগ সরু,বৃন্তদেশ হৃৎপিন্ডাকৃতি।পান পাতা ৫-৭টি শিরা বিশিষ্ট।শিরাগুলো পাতার নিচের দিকে উচ্চতর।মার্চ হতে মে মাস পর্যন্ত এর ফুল ও ফল হয়ে থাকে। পান গাছের লতা অথবা গাঁট রোপন করা হলে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং সাত মাসে পরিপূর্ণতা লাভ করে।আমাদের দেশে অনেক রকমের পান দেখা যায়। যেমনঃ বাংলা পান, ছাচি পান, মিঠে পান, কর্পুর গন্ধযুক্ত মিঠে পান ইত্যাদি।

ঐতিহাসিক তত্ত্বঃ পানের সাথে পরিচিতি নাই এমন লোক আমাদের দেশে বিরল পান আমাদের সংস্কৃতির একটি অন্যতম উপাদান। প্রায় তিনহাজার বছর পূর্ব থেকে পানের মান্যতা চলে আসছে। আগেকার দিনে রাজা-বাদশারা মুক্তার তৈরি চূর্ণ, কস্তুরী, জাফরান, সোনা ও রুপা তবক এবং নানাধিক সুগন্ধি মসলা দিয়ে পান খেতে অভ্যস্ত ছিলেন। সামাজিকতার ক্ষেত্রে পানের সমাদর অত্যধিক সবার শির্ষে। অনেকে খাওয়ার পর পান না চিবালে তৃপ্তি পায় না। পান খাওয়ার সময় মুখে যে লালা নিঃসৃত হয় তা পরিপাক সহায়ক।

ব্যবহার্য অংশঃ পাতা (পান) ও শিকড়।

মিযাজঃ বাংলা পান ও কর্পুর গন্ধযুক্ত মিঠে পানঃ দ্বিতীয় শ্রেণীর উষ্ণ ও শুষ্ক। মতান্তরে প্রথম শ্রেণীর উষ্ণ দিতীয় শ্রেণীর শুষ্ক। ছাঁচি পান ও মিঠে পান মোতাদেল প্রকৃতির অর্থাৎ প্রথম শ্রেণীর উষ্ণ ও শুষ্ক।

স্বাদঃ পান ঝাঁঝালো ও সুগন্ধযুক্ত। 

বর্ণঃ পান গাঢ় সবুজ বর্ণের।

সেবন মাত্রাঃ পান ৪-৫ গ্রাম পর্যন্ত সেবন করা যায়।

অপকারিতাঃ মাত্রাতিরিক্ত পান খেলে উষ্ণ প্রকৃতির লোকের মাথাব্যথা বা মাথা ঘোরা দেখা দিতে পারে।

সংশোধণঃ ছোট এলাচ, খয়ের ও সুপারী এর সংশোধক।

সাধারণ ক্রিয়াঃ দেহে প্রফুল্লতা আনয়ন করে, মেধাশক্তি বৃদ্ধি করে।হৃদযণ্ত্র,

মস্তিষ্ক ও যকৃতের শক্তিদায়ক। হজমকারক, মুখের দুর্গন্ধনাশক, দাঁত ও মাঢ়ীকে শক্তিশালি করে। মুখে অতিরিক্ত লালা, থুথু এবং পানি আসা রোধ করে।স্নায়ুউদ্দীপক, রতিশক্তিবর্ধক,শ্লেষ্মাজনিত পিপাসা নিবারক।পাচক, সংকোচক,সাধারন বলকারক এবং প্রশান্তিদায়ক।

ব্যবহারঃ ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিভিন্ন ওষুধ তৈরি ও ওষুধ প্রয়োগে পানের ব্যবহার অনেক রয়েছে। 

রোগ প্রতিকারে পানের ব্যবহারঃ (১) দাঁতের মাঢ়িতে পুঁজ ও ক্ষত হলেঃ ১ গ্লাস গরম পানির সাথে ৩ চা চামুচ পানের রস ও ৫ গ্রাম ফিটকিরি ভালো ভাবে মিশিয়ে পরবর্তীতে কলকুচি বা গাড়গল করতে হবে। উল্লেখিত পদ্ধতিতে প্রত্যহ ২/৩ বার করে গাড়গলী করলে মাঢ়ীর ক্ষত ও পুঁজপড়া কমে যায়।

(২)বাচ্চাদের কোষ্ঠবদ্ধতায়ঃ পানের বোঁটায় প্রয়োজনমতো সরিষার তেল বা গ্লিসারিন মেখে অত্যন্ত সাবধানে মলদ্বারে প্রবেশ করালে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাচ্চাদের পায়খানা হয়ে যায়।

(৩)শারীরিক ও যৌন দুর্বলতাঃ১০০ গ্রাম দারচিনি,৫০ গ্রাম শুঠ,২৫গ্রাম যত্রিক,২৫ গ্রাম সুনিয়াগোন্দ,২৫ গ্রাম অশ্বগন্ধা, ৩০ গ্রাম শতমূলী ও ৫০ গ্রাম আরবী গাম একত্রে মিশিয়ে রৌদ্রে কিংবা ড্রাই চেম্বারে শুখিয়ে হামানদিস্তায় মিহিচূর্ণ করে ৬০ মেশের চালনীতে চেলে নিন।এবার ১৫০মিলি পান পাতার রসে সংশ্লিষ্ট চূর্ণ ভালোভাবে খড়লের সাহায্যে মিশিয়ে ৫০০ মিঃ গ্রামের বড়ি তৈরি করে শুখিয়ে বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করুন। ১-২ বড়ি প্রত্যহ ২ বার দুধ অথবা মধুসহ নিয়মিত কিছুদিন সেবন করলে শুক্রতারল্য, শারীরিক দুর্বলতা ও যৌন দুর্বলতায় বিশেষ কার্যকরি।

(৪) পাকস্থলীর ব্যথা, পেটফাঁপা ও হজমের গোলযোগ নিরসনেঃ ১০০ গ্রাম জৈন(দেশী), ৫০ গ্রাম মোটা বচ, ৫০ গ্রাম পুদিনা(শুকনো), ৫০গ্রাম শুঁঠ, ২৫ গ্রাম বিট লবন, ২৫ গ্রাম আকন্দ ফুল, ৫০ গ্রাম আরবী গাম একত্রে মিশিয়ে রৌদ্রে কিংবা ড্রাই চেম্বারে শুকিয়ে হামানদিস্তায় মিহিচূর্ণ করে চেলে নিন।এবার ১০০মিলি পান পাতার রস সংশ্লিষ্ট চূর্ণে ভালোভাবে মিশিয়ে ৫০০মিঃ গ্রামের বড়ি তৈরী করে শুকিয়ে বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করুন।১-২ বড়ি প্রত্যহ ২ বার আহারের পর নিয়মিত কিছুদিন সেবন করলে পাকস্থলীর ব্যথা, পেটফাঁপা, বদহজম এবং ক্ষুধামান্দ্য নিরসনে আশাতীত উপকার হয়।  

(৫)নখকুনির ব্যথাঃ পানের রসের সাথে সামান্য খয়ের মিশিয়ে প্রত্যহ ৩/৪ বার নখের কোনায় দিলে ব্যথা কমে।

(৬) কানে পুঁজ হলেঃ পানের রস ঈষৎ গরম করে প্রত্যহ ২-৩ বার ১-২ ফোঁটা কানে দিলে বিশেষ উপকার হয়।

অন্যান্য প্রাপ্ততথ্যঃ জানা যায় পান পাতার রস মুখের জরতা, অরুচি, মুখের দুর্গ্ন্ধ ও  বদহজমে বিশেষ উপকারী। পান পাতার রস সাধারণ বলকারক, যৌন উদ্দীপক এবং শ্লেষ্মা অপসারক। লোকজ ব্যবহারে বুকে কফ আঁটকালে, শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হলে ১ চা চামুচ পান পাতার রস ও ১ চা চামুচ আদা রসের সাথে ২ চা চামুচ মধুসহ প্রত্যহ ২/৩ বার সেবন করে গেলে উপকার হয়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের গবেষণায় পান সুগন্ধকারক, স্নায়ুউদ্দীপক, বায়ুনাশক, রক্তরোধক, যৌনশক্তি বর্ধ্ক এবং পচোনরোধক। অধিক মাত্রায় খেলে কেন্দ্রিয় স্নায়ুতণ্ত্রে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।মনিষি সুশ্রুত বলেন পান উত্তেজক, ধারক, গলার স্বর পরিষ্কারক, মুখের দুর্গ্ন্ধনাশক,হজমকারক এবং পেটফাঁপা নিবারক।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পানের মধ্যে যে সব রাসায়নিক উপাদান পাওয়া গেছেঃ A.Phenolic compound Viz(প্যানলিক কম্পাউন্ড ভিজ),Chavicol(ক্যাভিকল),Hydroxychavicol(হাইড্রোক্সি ক্যাভিকল),B.Vitamin Viz(ভিটামিন ভিজ),ascorbic acid(এসকরবিক এসিড),C. Enzymis(এনজাইমস্),D. Essential oil(এসেস্নিয়াল ওয়েল),তাছাড়া পান পাতায় রয়েছে Protin 3.1(প্রোটিন ৩.১),Carbohydrates 6.1%(কার্বোহাড্রেটস ৬.১%), Minaral 2.3%(মিনারেল ২.৩%),Tannin 2%(ট্যানিন ২%)Calcium(ক্যালসিয়াম),Phosporas(ফসফোরাস),Iron(আয়রন),Iodin(আয়োডিন),Pattassium(পটাশিয়াম),Vitamin A.B.C(ভিটামিন এ.বি.সি)।