বাংলা বা স্থানীয় নামঃ ডালিম, দাড়িম

ইউনানী নামঃ আনার

আয়ুর্বেদিক নামঃ দাড়িম 

ফার্সী ও হিন্দি নামঃ আনার

আরবী নামঃ রুম্মান

ইংরেজী নামঃ Pomegranate

বৈজ্ঞানিক নামঃ Punica ageratum Linn.

পরিবারঃ Punicaceae

পরিচিতিঃ  ‘ডালিম’ এক প্রকার ফল।ডালিম গাছ আমাদের দেশের লোকের কাছে অতি পরিচিত। এটি ঘন শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট গুল্মজাতীয় গাছ।উচ্চতায় সাধারণতঃ ৪-৬ মিটার অবধী লম্বা হয়ে থাকে।গাছের ছাল ধুসর বর্ণের। পাতা ৪-৮সেঃমিঃ লম্বা এবং ১-১.৫সেঃমিঃ প্রশস্ত হয়ে থাকে।পাতার উভয় দিক সরু ও উপরিভাগ চকচকে এবং মসৃন।শাখাতেই পাতা হয়। শাখার অগ্রভাগে এক বোটায় দু,টি করে ফুল ধরে। ফুল লাল বর্ণের। কাঁচা অবস্থায় সবুজ ও পাঁকলে লাল বা হলদে ভাব হয়।সাধারণতঃ মে মাসে ফুল আসে আর আগষ্ট-সেপ্টেম্বরে ফল পাকে। ফল অনেকটা গোলাকার, ফলের মধ্যে একাধিক বীজ থাকে। বীজের বাহিরে রসালো লাল বর্ণের শাঁস থাকে। কোন কোন ডালিমের বীজ ছোট ও সামান্য সরু হয় বলে একে বেদানা বলে । বিশেষতঃ কাবুলে উৎপাদিত ডালিমকে বেদানা বলা হয় এবং তাহাই সর্বোত্তম । অণ্ঞল ভেদে ডালিমের আকৃতি ও স্বাদের পার্থক্য দেখা যায়।    

বিভিন্ন প্রকার প্রামাণ্য গ্রন্থে তিন প্রকার ডালিমের উল্লেখ পাওয়া যায়।  যেমনঃ- মিষ্টি ডালিম বা আনার শিরীন, টক ডালিম বা আনার তুরশ এবং টক মিষ্টি ডালিম বা আনার মায়খোস।প্রকারভেদ যাহাই হোক না কেন একটির পরিবর্তে অন্যটি ব্যবহার করা যায় ।এতে গুনাগুনের তেমন তারতম্য পরিলক্ষিত হয় না । সুতরাং নির্দিষ্ট প্রকার ডালিমের অভাবে যেটি পাওয়া যাবে তাহাই ব্যবহার করা যেতে পারে ।

ব্যবহার্য্ অংশঃ ফুল,ফল,ফলের রস,ফলের খোসা,বীজ,গাছের বাকল ও পাতা ।

মিযাজঃ

মিষ্টি ডলিমঃ প্রথম শ্রেণীর শীতল ও আর্দ্র, তবে অনেক মনিষীদের মতে মোতাদেল বা সমগুন বিশিষ্ট ।

টকমিষ্টি ডালিমঃ দ্বিতীয় শ্রেণীর শীতল ও আর্দ্র । মতান্তরে দ্বিতীয় শ্রেণীর শীতল ও শুষ্ক ।


উপাদান সেবন মাত্রা
মিষ্টি ডালিমের রস ২০–১০০ মিঃলিঃ
শুকনো খোসা ৩–৫ গ্রাম
টকমিষ্টি ডালিমের রস ২০–৭০ মিঃলিঃ
টক ডালিমের রস ২০–৫০ মিঃলিঃ
ডালিম ফুল চূর্ণ ১–৩ গ্রাম

সাধারণ ক্রিয়াঃ ক্ষুধাবর্ধক, হৃদযন্ত্রের শক্তিদায়ক, পিপাসা নিবারক,প্রশান্তি দায়ক,পাকস্থলী ও যকৃতের শক্তিবর্ধক, পুষ্টিকারক,শরীরের জ্বালাপোড়া নিবারক,বিশুদ্ধ রক্ত সৃষ্টিকারক, পিত্তজনিত জ্বর ও বমি নিবারক, মুত্রকারক, ডালিমের ফুল রক্তরোধক, জরায়ুর শক্তিবর্ধক এবং শ্বেতপ্রদর ও রক্তপ্রদরে অত্যন্ত কার্যকরী।

আময়িক ব্যবহারঃ প্রাচীনকাল হতে ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিভিন্ন ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে ডালিম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে এর কার্যকারিতা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত।ডালিম গাছের কান্ড, ছাল বা বাকল ও ফলের খোসায় ২২-২৫%(Tannic Acid)মূলের ত্বকে ২০-২৫%(Punico-Tannic Acid)বিদ্যমান রয়েছে। মূলে এক প্রকার ক্ষার পাওয়া যায়। তাছারা ফলের মধ্যে শর্ক্রা ১৫ ভাগ,পেকটিন এবং মনাইড প্রভৃতি পাওয়া যায়।ইউনানী চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডালিম সম্বলিত যে সকল গুরুত্বপূর্ণ্ ওষুধ তৈরি করা হয়, এখানে কয়েকটি ওষুধের নাম উল্লেখ করা হল- জওয়ারিশ আনারাইন, জওয়ারিশ তমরহিন্দি, মা’জুন নুশারা, লউক বিহিদানা, কুরছ গুলনার,হাব্বে জীকুন-নাফাস্ প্রভৃতি। 

রোগ প্রতিকারে ডালিম 

১/ আমাশয়েঃ ডালিমের কাঁচা খোসা ১০ গ্রাম নিয়ে এক গ্লাস পানিতে জ্বাল করে অর্ধেক থাকতে নামিয়ে ছেঁকে সকাল-বিকাল সেবন করে গেলে আমাশয়ে আশাতীত উপকার হয় ।কাঁচা খোসার অভাবে শুকনো খোসা ৫ গ্রাম পরিমাণে দেয়া যেতে পারে।

২/ অনিদ্রায়ঃ যাদের রাতে ভালো ঘুম হয় না।প্রায়ই ঘুমের ওসুধ খেয়ে ঘুমাতে হয় তারা ডালিমের রস ৩-৪ চা চামুচ ও ঘৃতকুমারীর শাঁস ২ চা চামুস মিশিয়ে খেলে অনিদ্রা সেরে যায় এবং ভালো ঘুম হয়।

৩/শিশুদের লিভার বৃদ্ধিতেঃ শিশুদের লিভার বেড়ে গেলে পেট বড় হয় এবং পেটের ডান দিকে চাপ দিলে ব্যাথা বোধ হয়। এক্ষেত্রে ডালিম গাছের মূলের ছাল শুকিয়ে চূর্ণ্ করুন ।৫০০মিঃ গ্রাম পরিমান চূর্ণ্ নিয়ে ২ চা চামুচ দুধ এবং ৫ ফোঁঠা মধু মিশিয়ে সকালে সেবন করতে হবে । উক্ত নিয়মে কয়েকদিন নিয়মিত সেবন করে গেলে বিশেষ উপকার হয় ।

৪/ প্রদরেঃ ডালিমের ফুল ২টি, শ্বেতচন্দন ১ গ্রাম মিশিয়ে চূর্ণ্ করে উক্ত চূর্ণ্ সকাল ও বিকেলে দুধ অথবা মধুসহ সেব্য । নিয়মিত কিছুদিন সেবনে আশাতীত উপকার পাওয়া যায ।

৫/অতিসার ও রক্তাতিসারেঃ ডালিম ফল ও খোসা ১০ গ্রাম, কুরচি ছাল ১০ গ্রাম এবং বেলশুঁঠ ৫ গ্রাম নিয়ে আধাচূর্ণ্ করে ১২৫ মিলি দুধ ও ২৫০ মিলি পানি মিশিয়ে জ্বাল করতে থাকুন । এক কাপ পরিমান অবশিষ্ট থাকতে চুলা হতে নামিয়ে ছেকে নিয়ে সকাল ও বিকালে সেব্ন করুন । নিয়মিত কিছুদিন সেবনে আশাতীত উপকার পাওয়া যায় । 

৬/ প্রস্রাবের জ্বালাপোরা ও মূত্রকৃচ্ছ্রতাঃ ২০ মিঃ ডালিমের রস, এক কাপ আরক বাদিয়ান বা আরক গোলাপের সাথে মিশিয়ে ২ গ্রাম পরিমান গোক্ষুরচূর্ণ্ সহ সেব্য । উল্লেখিত নিয়মে প্রত্যহ ২ বার সেবন করে গেলে ৭-১০ দিনের মধ্যে প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া ও মূত্রকৃচ্ছ্রতায় আশাতীত ফলপাওয়া যায়। 

৭/ পাকস্থলী, যকৃত ও হৃদযন্ত্রের দুর্ব্লতাঃ ২৫ মিলি ডালিম ফলের রস, ৫০ মিলি আরক গোলাপ, ৫০ মিলি আরক পুদিনা একত্রে মিশিয়ে প্রত্যহ ২ বার সেবন করে যেতে হবে । নিয়মিত কিছুদিন সেবন করে গেলে পাকস্থলী, যকৃত ও হৃদযন্ত্রের দুর্ব্লতায় অত্যন্ত উপকারি ।

অন্যান্য প্রাপ্ত তথ্যঃ ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডালিমের  ব্যবহার প্রচুর দেখা যায় । মিষ্টি ডালিম ত্রিদোষ নাশক, শুক্রবর্ধ্ক, হৃদযন্ত্রের শক্তিদায়ক, মূত্রাশয়, মূত্রথলি ও জরায়ুর শক্তিবর্ধ্ক । এর রস শরীরের জ্বালাপোড়া, পিপাসা নিবারক, রুচিকারক, তৃপ্তিদায়ক, মেধাশক্তি বর্ধ্ক ও সাধারন বলকারক । টকমিষ্টি ডালিম রুচিকারক, অম্লপিত্তবর্ধ্ক এবং লঘুকারক । টক ডালিম কফ নিঃসারক, বায়ুনাশক ও পিত্তবর্ধ্ক । ডালিম গাছের পাতা ও ছাল সংকোচক, ধারক, রক্ত আমাশয়, পাতলা পায়খানা এবং কৃমি নাশক । ডালিম ফলের রস স্নিগ্ধকারক, পিপাসা নিবারক, জ্বর, অতিসার, অজীর্ণ্, ক্ষুধামান্দ্য প্রশমিত করে দেহের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনে । ডালিমের রস যকৃতের ত্রিয়ার সংশোধক । এতে Vitamin B ও C পাওয়া যায় । ডালিম ফলের খোসা ও ফুল পুরাতন আমাশয়, রক্ত আমাশয়, । অতিরিক্ত রক্তস্রাব এবং বদহজমে বিশেষভাবে কার্য্কর । 

বৈজ্ঞানিক উপায়ে ডালিমের রাসায়নিক উপাদানঃ

Pelletierine alkaloids(পিলিটাইরিন এ্যালকালয়েড),isoeelletierine alkaloids(আইসোপিলিটাইরিন এ্যালকালয়েড),methylisopelletierine alkaloids(মিথাইল আইসোপিলিটারিন এ্যালকালয়েড),sorbitol(সরবিটল),mannitol(ম্যানিটল),glucose(গ্লুকোজ),Fructose(ফ্রুকটোজ),Sucrose(সুক্রোজ),isoquercetin(আইসোকউরেকটিন),betasitosterol(বিটাসিটোস্টিরল),friedelin(ফ্রাইডেলিন),estrone(ইস্টোরন),pectin(পেকটিন),triterpenoids(ট্রাইটারপেনয়েড্স্)citric acid(সাইট্রিক এসিড),calcium(ক্যা্লসিয়াম),iron(আয়রন),sodium(সোডিয়াম)এবং pottasium(পটাশিয়াম)।